স্টাফ রিপোর্টার||
এ যেন এক আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার গল্প। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারি লিটন এখন শত কোটি টাকার মালিক। সামান্য একজন কর্মচারি কয়েক বছরের ব্যবধানে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার বিষয়টি অনেকের কাছে অজানা হলেও তার জন্মস্থান দ্বীপ জেলা ভোলার দৌলতখান উপজেলার উত্তর জয়নগর ইউনিয়নবাসীর কাছে এটি এক আতঙ্কের গল্প। বলছি ভোলার দৌলতখান উপজেলার উত্তর জয়নগন ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইয়াসিন লিটনের কথা।
মাত্র কয়েক বছর আগেও যে মানুষটি ঢাকার হাতিরপুল এলাকায় ইন্টার্ন প্লাজার পাশে উদয়ন এন্টারপ্রাইজ নামক দোকানটিতে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারি ছিলেন, বর্তমানে সেই মানুষটি শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। কিন্তু কি ভাবে এতো স্বল্প সময়ে একটি দোকানের কর্মচারি লিটন এতো টাকার মালিক হলো ?
আজ সেই সাবেক চেয়ারম্যান লিটনের অর্জিত অর্থ সম্পদের বিবরণীর পাশাপাশি জানাবো তার জিরো থেকে হিরো হওয়ার গল্প।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, তৎকালীন সময়ে ঢাকা মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্তরের শরীফ মুজাহিক নামক একটি দোকানে লিটন ও তার ছোট ভাই রিপন চারে চার হাজার টাকা বেতনের কর্মচারি হিসেবে যোগদান করেন। প্রায় ৫/৬ বছর ওই দোকানে কাজ করার পর বড় ধরনের অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারীর ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সেখান থেকে তাদেরকে চাকুরিচ্যুত করেন দোকান মালিক। এরপর ঢাকার হাতিরপুল এলাকায় ইন্টার্ন প্লাজার পাশে উদয়ন এন্টারপ্রাইজ নামক আরেকটি মুজাহিক পাথরের দোকানে পাঁচ হাজার টাকা বেতনে লিটন ও ছোট ভাই রিপন চার হাজার টাকা বেতনে কর্মচারি হিসেবে নিয়োগ নেন। যদিও সেই দোকানের মালিক ইঞ্জিনিয়র হিসেবে চাকুরিরত থাকার সুবাধে তিনি প্রতিষ্ঠানে তেমন সময় দিতে না পারায় লিটন ও ছোট ভাই রিপন দুজনেই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার মুল দায়িত্বভার গ্রহন করেন। দীর্ঘ সময় চাকরির এক পর্যায়ে সেখান থেকেও মোটা অংকের টাকা অত্মসাৎ করে তারা দুজনই সেখান থেকে সটকে পড়ে চলে আসেন নিজ জেলা ভোলার দৌলতখানের উত্তর জয়নগর ইউনিয়নের তার নিজ বাড়িতে।
পকেট ভর্তি গরম গরম টাকা, পাড়া মহল্লাসহ বিভিন্ন কাজে ১০ টাকার স্থানে ৪০/৫০ হাজার টাকা খরচ করে এলাকায় তরুন ও যুবসমাজের লোকজন সহ বিভিন্ন মুরুব্বিদের কাছে কিছুটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন লিটন। এরপর থেকেই জনপ্রতিনিধি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন পুরো উত্তর জয়নগর ইউনিয়ন। পকেট ভর্তি চুরি করা টাকা নিয়ে শুরু হয় তার ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের রাজনীতি ও রামরাজত্ব।
এরপর ২০১১ সালের ইউপি নির্বাচনে তৎকালীন দৌলতখান পৌরসভার মেয়র ও আলী আজম মুকুলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে উত্তর জয়নগর ইউনিয়নের নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে তিনি আনারস প্রতিক নিয়ে শরু করেন নির্বাচনী প্রচার প্রচারনা। কিন্তু ওই নির্বাচনে দেখা গেছে অপর প্রার্থী তালা প্রতিকের মোঃ সফিজল ইসলাম নির্বাচিত হলেও ক্ষমতা ও অর্থের দাপটে কারচুপির মাধ্যমে চেয়ারম্যান পদে লিটনকে নির্বাচিত ঘোষনা করা হয়। যদিও সে সময় বিষয়টি নিয়ে পুনরায় ভোট গননার দাবী নিয়ে ভোলার আদালতে অপর প্রার্থী সফিজলের দায়ের করা মামলা টানা দুই বছর অতিবাহিত হলেও স্থানীয় রাজনীতিবীদের চাপের মুখে সেই মামলাও তুলে নিতে বাধ্য হয় প্রার্থী সফিজল। এরপর উত্তর জয়নগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর লিটনকে আর পিছনের দিকে তাকাতে হয়নি। চেয়ারম্যান হিসেবে শপথ নেয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই বেরিয়ে আসেছে তার আসল রূপ। একের পর এক নারী গঠিত কেলেঙ্কারী, জমি দখল, ইউনিয়নের বরাদ্ধকৃত টনকে টন চাল আত্মসাত, বিচারের নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতানো, চল্লিশ দিনের কর্মসূচী, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, নাপিত ভাতাসহ বিভিন্ন সময় বন্যা ঝড় জলোচ্ছাসের কোটি কোটি টাকার অনুদান অত্মসাৎ ও লুটপাটের করে অল্প সময়ের মধ্যেই চেয়ারম্যান লিটন শতকোটি টাকার মালিক বনে যান।
স্থানীয়রা বলছেন, উত্তর জয়নগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে ইয়াসিন লিটন নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই পুরো ইউনিয়ন জুড়ে শুরু হয়েছে তার রামরাজত্ব। নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা গুলো ছিলো তার রুটিন ওয়ার্ক। তেমনী তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সময়ে তাসলিমা বেগম নামক এক নারীকে রাতভর গনধর্ষণ ও নির্যাতন করে মুমুষ্য অবস্থায় তাকে ফেলে রাখেন দৌলতখানের সড়কের পাশে। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করার। তৎকালীন সময় ওই নারীর মেয়ে মুন্নি আক্তার বাদি হয়ে মামলা করলে পরবর্তীতে মামলার বাদি মুন্নিকেও একই ভাবে তাদের হাতে গনধষনের স্বীকার হতে হয়। এরপর মা ও মেয়ের দায়ে করা দুটি ধর্ষন মামলার প্রধান আসামী হিসেবে চেয়ারম্যান লিটনের নাম চলে আসলেও এখন পর্যন্ত ওই মামলার ওয়ারেন্ট ভুক্ত আসামী হয়ে লিটন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও অদৃশ্য ক্ষমতার বলে পুলিশ এখনো তাকে গ্রেপ্তার করেনি। এছাড়াও আরো বহু ধরনের নারীগঠিত বিষয় নিয়ে ওই সময় বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক গনমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশ হলেও টনক নড়েনি লিটন ও তার সহযোগীদের। বর্তমানে ওই তাসলিমা বেগম ওই ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনের ইউপি সদস্য হিসেব দায়িত্ব পালন করছেন।
বিষয়টি নিয়ে তার সাথে কথা হলে তিনি জানান, লিটনের ক্ষমতার কাছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ বরাবরই জিম্মি হয়ে আছে। তা না হলে আমি ও আমার মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া এতো বড় ঘটনার এখন পর্যন্ত বিচার না পাওয়ার বিষয়টি খুবই দুঃখ ও হতাশা জনক বলে জানান তিনি।
শুধু তাই নয়, তার নির্বাচনী এলাকা ছাড়াও পুরো দৌলতখান উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ঝামেলাযুক্ত জায়গা জমিতে নিজের লোক দিয়ে আরো ক্রন্দল সৃষ্টি করে এরপর সালিশ মীমাংসা মধ্য দিয়ে নামমাত্র মূল্যে সেই সকল জমিজমা নিজের মা বাবা, স্ত্রী, ভাই, বোন, শেলক ও শালিকাদের নামে রেজিট্রি করে রেখে দেন। তাছাড়া দুই পক্ষের ঝামেলাকৃত জমি জবরদখল করা যেন তার নেশা হয়ে দাড়িয়েছে। বর্তামানে তার নামে বেনামে সম্পদের পরিমান শতকোটি ছাড়িয়ে গেছে।
তার মধ্যে রয়েছে, জয়নগন সাজি বাড়ির পাশে লিটনের স্ত্রী রিনা বেগমের নামে ৬১ বিঘা জমির উপর গড়ে তোলা হয়েছে ফার্ম হাউজ। যেখানে রয়েছে, শতাধিক গরু ও ১০টি পুকুর। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। একই ইউনিয়নের সরকার বাড়ির মসজিদের পাশে ব্রীজের সাথে ১ বিঘা জমির উপর নির্মিত হয়েছে ৫টি দোকান। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। উত্তর জয়নগর ইউনিয়ন পরিষদের উল্টো পাশে ১ বিঘা জমির উপর প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যায়ে ১০ তলা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রাথমিক ভাবে নির্মিত হয়েছে দুই তলা ভবন। ভোলা উপ-শহর নামে পরিচিত বাংলাবাজারের হিন্দুদের ১৫ কাঠা জায়গা দখল করেছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৮ কোটি টাকা। বর্তমানে সেখানে ১০ তলা মার্কেট নির্মানের কাজ চলমান রয়েছে। রয়েছে জয়নগন হাফিজ ইব্রাহিম কলেজের পাশে ২ বিঘা জমির উপর পুকুর ও মাছের ঘের। যার বাজার মূল্য ৬ কোটি টাকা। বাংলাবাজারের পূর্বে বড় মোল্লা বাড়ির মোল্লার বিল এলাকার বহু জায়গা দখল করে সেখানেও বানিয়ে বিশাল ফার্মহাউজ।
এছাড়া লিটনের ছোট ভাই জুয়েল হোসেন রিপনকেও দেয়া হয়েছে ঢাকার হাতিরপুল ৪৭ বীর উত্তম সি আর সড়কে (৩৪ পরিবাগ) ৫০ লক্ষ টাকা জামানত চুক্তিতে ডোর গ্যালারী নামক দরজা ও সিরামিকের দোকান। যেখানে মূলধনই রয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকার। একই এলাকার ৪৮ পরিবাগে আর এস এস এন্টারপ্রাইজ নামে রয়েছে আরেকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সেটিতে ৫০ লক্ষ টাকা জামানত চুক্তিতে প্রায় ২ কোটি টাকার মূলধন নিয়ে সেখানেও রাজকীয় ভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন ছোট ভাই রিপন। বর্তমানে ঢাকার মানিককান্দিতে বসবাসরত দুটি ফ্লাট রয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা। যদিও ইয়াসিন লিটন দুদক সহ বিভিন্ন ধরনের আইনের ঝামেলা এড়াতে তার নিজের নামে মাত্র ৬০ শতক জমি দেখিয়ে বাকি সকল সম্পত্তি তার বাবা রফিকুল ইসলাম, মাতা মোনজুরা খাতুন, স্ত্রী রিনা বেগম, বোন শাহিদা বেগম, নাহার বেগম, নিহার বেগম, ইয়াসমিন বেগম ও নিপা বেগম সহ তার শেলক শালিকাদের নামে দেখিয়েছেন। এ সকল সম্পত্তির মধ্যে অধিকাংশ সম্পত্তিই জবর দখলের মধ্য দিয়েই অর্জন করেছে লিটন। যা গত কয়েক দিনের অনুসন্ধানে এমনটি ওঠে এসেছে তার নিকটতম প্রতিবেশি ও আত্মীয় স্বজনসহ বিভিন্ন মহলের দেয়া তথ্যের মধ্য দিয়ে।
এ ব্যাপারে লিটনের চাচা নুরনবী ও বশির আহমেদের সাথে কথা হলে তারা কান্না জনিত কণ্ঠে বলেন, লিটন ছোট বেলা থেকেই অনেকটা উশৃংখল ছিলো। কিন্তু চেয়ারম্যান হওয়ার পর সে এতোটাই বেপরোয়া হয়ে গেছে যে তার পাড়া প্রতিবেশি বাদই দিলাম সে তার আত্মীয় স্বজনকেই কোনভাবে ছাড় দেয়নি। আমাদের বহু জমি লিটন ও তার ভাইয়েরা মিলে জবর দখল করে নিয়ে সেখানে ফার্ম হাউজ করেছে। তা নিয়ে আমরা আইন আদালত করেও কোন ধরনের শুরাহা পাইনি।
একই কথা বলে লিটনের চাচাতো ভাই শাজাহান মাষ্টারের ছেলে মোরশেদ ও মিজান জানান, তাদের বাড়ির উত্তর পাশের অধিকাংশ জমি দীর্ঘ দিন যাবত তাদের পত্রৈক সম্পত্তি হিসেবে তারা ভোগ দখল করে আসলেও ইয়াসিন লিটন চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই জোর পূর্বক এক এক করে জবর দখল করে নিয়েছে তাদের অধিকাংশ জমিজমা। এ সব নিয়ে আদালতে মামলা চলমান থাকলেও আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ওই সকল জমির উপর রীতি মতো চলছে ভবন নির্মান সহ বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ড।
এতো সব অভিযোগের পাহাড় মাথায় নেয়া সাবেক চেয়ারম্যান ইয়াসিন লিটনের সাথে কথা হলে তার বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াড দাবী করে তিনি বলেন, আমরা পূর্ব থেকেই বহু অর্থ সম্পদের মালিক। তাছাড়া আমি ব্যক্তিগত ভাবে যা কিছুই করেছি তা আমার ঢাকা সহ বিভিন্ন দিকে ব্যবসা বানিজ্যের মাধ্যমেই করেছি। এ বলে তিনি এ বিষয়টি নিয়ে কোন সংবাদ প্রকাশ না করে বরংচ এই প্রতিবেদকের সাথে একান্তভাবে সাক্ষাত করতে চেয়ে অনুরোধ জানান তিনি।
তবে লিটনের অপকর্ম নিয়ে তার নিকটতম প্রতিবেশি ও আত্মীয়স্বজনদের পাশাপাশি বিভিন্ন ভুক্তভোগীরা আইন আদালত সহ সমাজের সর্বস্থরের গন্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে গিয়েও কোন ধরনের সুরাহ না পেলেও সামান্য ৫ হাজার টাকার বেতনের কর্মচারি লিটন তার নিজ এলাকায় অনিময় দুর্নীতি, জবরদখল, বিভিন্ন মানুষের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন নিপিরনের মধ্য দিয়ে স্বল্প সময়ে শত কোটি টাকার মলিক বনে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে দেশের দুর্নীতি দমন বিভাগ (দুদক) এ সকল বিষয় গুলোর প্রতি একটু সু-দৃষ্টি দিবেন এমনটি কামনাই করছেন দৌলতখান উপজেলার উত্তর জয়নগর ইউনিয়নের ভুক্তভোগী কয়েক হাজার মানুষ।
You cannot copy content of this page