ভোলা জার্নাল ডেস্ক রিপোর্ট ||
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে অস্থির দেশের রাজনীতি। বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে অনড় অবস্থানে দুদল। সংকট নিরসনে আপাতত সংলাপ বা সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা নেই। এমন পরিস্থিতিতেও সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে-আগামী নির্বাচন হবে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ। কিন্তু দুই দলের মুখোমুখি অবস্থানে কীভাবে সেটা সম্ভব-এমন প্রশ্নই সব শ্রেণি-পেশার মানুষের। রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকার অলিগলির চায়ের দোকান, হাট কিংবা ঘাটে, অফিস-আদালতে, সামাজিক অনুষ্ঠানসহ সর্বত্রই আলোচনা-কী হবে আগামী দিনে। নির্দিষ্ট সময়ে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি না। না হলে রাজপথে কি ফের শুরু হবে সংঘাত, জ্বালাও-পোড়াও। রাজনৈতিক সংকট তীব্র হওয়ার আশঙ্কায় জনমনে বাড়ছে নানা উৎকণ্ঠা। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, চা দোকানদার, কৃষক, আইনজীবীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। তাদের মতে, সংকট সমাধানের কোনো উদ্যোগ না থাকায় রাজনৈতিক-সচেতনদের মধ্যে আগে থেকেই উদ্বেগ লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এ উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে। দুদলের মুখোমুখি অবস্থান ও নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সরাসরি হস্তক্ষেপ তাদের উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে দেশ চরম অনিশ্চয়তায় পড়বে। মুখ থুবড়ে পড়বে দেশের অর্থনীতি। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এবং দেশে নানা সিন্ডিকেটের কারণে চাল, ডাল, তেল, মসলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এমনিতেই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। প্রতিদিনের খাদ্যসামগ্রী কিনতেই তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে নিত্যপণ্যের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটা আন্দাজ করা সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাই কঠিন হবে।
তারা মনে করেন, আগামী নির্বাচন দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সব দলের অংশগ্রহণে সেই নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার কামড়াকামড়ি বন্ধ করতে হবে। দেশের স্বার্থে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। মুখে যাই বলুক, শেষ পর্যন্ত আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান হবে-এমনটাই প্রত্যাশা তাদের। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সাধারণ মানুষের মতো এ উদ্বেগ আমাদেরও। আমরা একটা অপরাজনীতির কবলে পড়ে গেছি। রাজনীতি হলো একটা প্রক্রিয়া। আলাপ-আলোচনা, মতবিনিময়ের মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছানো এবং সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া। এখন আমাদের রাজনীতি এমন হয়ে গেছে-একে অপরের ছায়াও মাড়ায় না। কথাও বলে না। বৈরিতার সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে রাজনীতিকে আমরা খেলার সমতুল্য করে ফেলেছি। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি, জনগণের স্বার্থে আমাদের রাজনীতিবিদদের বোধোদয় হবে। আলোচনার মাধ্যমে তারা সমস্যার সমাধান করবে। রাজনীতি চর দখল বা যুদ্ধ নয়। রাজনীতিবিদরা সেটা অনুধাবন করে তারা সমঝোতায় পৌঁছাবে। জাতিকে চরম বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে। এটা তাদের কাছে সনির্বন্ধ নিবেদন। সবার চাওয়া সেটাই। সংকটের সমাধান হলেই দেশবাসীর উদ্বেগের অবসান হবে।
বদিউল আলম মনে করেন, শুধু সাধারণ মানুষ নন, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। সরকারি দল মনে করছে তারা ক্ষমতায় যেতে না পারলে দমন-পীড়নের শিকার হবেন কি না। বিরোধী দলের উদ্বেগ হলো-তারা আবার দমনের শিকার হতে পারেন। দুদিকেই দমন-পীড়নের উৎকণ্ঠা। দেশের এমন পরিস্থিতিতে আবার বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে আলোচনার বিকল্প নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রত্যাশা ছিল-অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রভাবশালী দেশগুলোর নানামুখী চাপে সংলাপের সম্ভাবনা তৈরি হবে। কিন্তু বিদেশি চাপের পর বড় দুই দলের দূরত্ব আরও বেড়েছে। এ ইস্যুতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে ব্যস্ত তারা। নেতাদের নিত্যদিনের ভাষণ শুনে সবাই হাসাহাসি করেন। নেতারা কোনো দায়িত্বশীল কথা বলেন না। তাদের মূল লক্ষ্য ক্ষমতা। দেশের জনগণের চিন্তা তাদের নেই।
বিভিন্ন এলাকার নিম্ন-আয়ের মানুষের ভাবনা কিছুটা ভিন্ন। আগামী দিনে নির্বাচন হবে কি না কিংবা দেশের পরিস্থিতি কী হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা করার সময় তাদের নেই। নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে কীভাবে সংসার চালাবেন, তা ভেবেই দিন চলে যায়। ফের যদি রাজপথে সংঘাত হয়, তাহলে কীভাবে সংসার চালাবেন, তা নিয়েও উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে তাদের।
বেশিরভাগ গনমাধ্যমগলোর বরিশাল বিভাগীয় ব্যুরো সূএে জানায়, রাজনৈতিক অস্থিরতায় আগামী দিনে কী হবে, তা নিয়ে এ বিভাগের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে উদ্বেগ লক্ষ করা যাচ্ছে। নির্বাচন হবে কি না, না হলে দেশে কী হবে-সর্বত্রই এমন আলোচনা। নতুন ভোটার শিক্ষার্থী রাসেদ হোসেন বলেন, সরকার যদি নিজের ভোট নিজে দেওয়ার মতো সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে কেন্দ্রে যাব।
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, এ এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যেও বাড়ছে উৎকণ্ঠা। চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজশাহী নিউমার্কেটের বস্ত্র ব্যবসায়ী শাহ শফিকুল ইসলাম বলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে আমরা কিছুটা উদ্বিগ্ন। নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষ সরকারের ওপর খুবই ক্ষুব্ধ। তারপরও আমরা চাই-দেশে সুষ্ঠু একটি নির্বাচন হোক। নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর রেষারেষিতে দেশের পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার দিকে যাক, এটা আমরা দেখতে চাই না। দেশের চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বেশ খোঁজ রাখেন অটোরিকশাচালক নবাব আলী। ষাটোর্ধ্ব এই নাগরিকের মতে, রাজনৈতিক নেতাদের কথাবার্তা শুনে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। আওয়ামী লীগ চাইছে ক্ষমতা ধরে রাখতে। বিএনপি চাইছে ক্ষমতায় যেতে। একবেলা অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় না নামলে আমার পরিবার চলে না। কিন্তু নেতাদের তো পেটের চিন্তা করতে হয় না। দেশের মানুষ সুষ্ঠু একটা নির্বাচন চান। আমিও চাই। নগরীর সাহেববাজার ফুটপাতের ব্যবসায়ী মহসিন আলি প্রামাণিক বলেন, এভাবে দেশ চলে না। আমার মনে হয়, একটা ভালো নির্বাচন হলে যে দল জনগণের রায় পাবে, তারাই ক্ষমতায় যাবে। ক্ষমতার জন্য দাঙ্গা-সহিংসতা মানুষ দেখতে চায় না। দলগুলো নিজেদের বিরোধ মিটিয়ে চলুক, এটাই সবাই চায়।
খুলনা ব্যুরো জানায়, দক্ষিণের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যেও আলোচনার মূল বিষয় আগামী নির্বাচন। নির্বাচন না হলে কী হবে-এমন নানা অনিশ্চয়তা তাদের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগও তৈরি করেছে। আলোচনার শেষে সবারই একই কথা-এ সংকটের সমাধান হোক। সব দল মিলে যেন একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়। খুলনার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আনোয়ারুল কাদির বলেন, নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি নানামুখী তৎপরতায় উদ্বিগ্ন মানুষ। নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশিষ্ট আইনজীবী কুদরত ই খুদা বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি বলতে এখনো দুটি ধারা-একটি আওয়ামী লীগপন্থি এবং অপরটি বিএনপিপন্থি। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে এ দুটি দল ছাড়াও সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। এই দায়িত্ব সরকারের। যখন সরকার ব্যর্থ হবে, তখন বিদেশি শক্তি মাথাচাড়া দেবে। এই অবস্থা উত্তরণে সরকারকে ক্ষমতায় থাকার চতুরতা থেকে বেরিয়ে নিরপেক্ষভাবে সবাইকে নিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কাজ করতে হবে। তাহলে দেশের মঙ্গল হবে।
বেসরকারি চাকরিজীবী ফিরোজ মাহমুদ বলেন, আমি ভোটার হয়েছি ২০০৮ সালে। এরপর কখনো ভোট দিতে পারিনি। এখন ভোট দেওয়ার পরিবেশ চাই। তা না হলে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন হলে দেশ আবার সহিংসতার দিকে ধাবিত হবে। অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর হয়ে পড়বে দেশ। আমার মতো অনেকেই বেকার হয়ে পড়বে। দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ না এলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, বাণিজ্য নগরীর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে একই আলোচনা-কী হবে আগামী দিনে। দুই দলের অনড় অবস্থান চট্টগ্রামেও সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। তারা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে হবে কিংবা আদৌ হবে কি না, না হলে পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হবে কি না, দেশ সংঘাতের পথে যাবে কি না-এসব নিয়েই চলছে নানা জল্পনাকল্পনা। চায়ের দোকানের আড্ডা, অলিগলিতে, হাটবাজারে-সর্বত্র এমন আলোচনা চলছে। সচেতন নাগরিক সমাজ চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘দেশের সাধারণ মানুষ, যারা আপেক্ষিক অর্থে দলনিরপেক্ষ, তাদের যে পর্যবেক্ষণ সেটা হলো-কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে-এমন নজির নেই। সংবিধানের কথা বলে সরকার কৌশলী আচরণ করছে বলেই আমার মনে হচ্ছে। তবে সুষ্ঠু একটা নির্বাচন না হলে অনিয়মের রাজত্ব বাড়বে। অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে হয়তো ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন হয়ে যাবে। সামনে কী হবে, এটি নিয়ে আমরা উৎকণ্ঠায় রয়েছি।’ নগরীর কদমতলী এলাকার মোটরসাইকেল মিস্ত্রি নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘এ দেশের নাগরিক হিসাবে ভোট দেওয়া আমার অধিকার। কিন্তু ভোটার হওয়ার পর এখনো ভোট দিতে পারিনি। তাই ভোট দিতে মুখিয়ে আছি।’
ফরিদপুর ব্যুরো জানায়, এখানকার চায়ের দোকানসহ সর্বত্র একই আলোচনা-কী হচ্ছে আগামী দিনে। এ বিষয়ে চরকমলাপুর এলাকার দোকানদার মো. শাহজাহানের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, বাজারে দ্রব্যমূল্যের যে অবস্থা তাতে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাই কষ্টকর। এরপর যদি দেশে অস্থিরতা থাকে, তাহলে মানুষের বেঁচে থাকা আরও কষ্টকর হয়ে পড়বে। মুনশিবাজারের হাছান শেখ বলেন, চায়ের দোকানে বসলেই নানা আলোচনা কানে আসে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে? আগের মতো হবে নাকি বিদেশিদের হস্তক্ষেপে ভালো নির্বাচন হবে। এ নিয়ে যেন মানুষের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। চকবাজার এলাকায় চা পান করতে আসা অনেকেই বলেন, আর যাই হোক, আগের মতো এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে না।
বগুড়া ব্যুরো জানায়, দেশের অন্যান্য এলাকার মতো এখানেও একই আলোচনা। সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) বগুড়া শাখার সাধারণ কেজিএম ফারুক বলেন, দেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অন্যদের আস্থা অর্জনে সরকারকে সবার আস্থাভাজন ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ পুনর্গঠন করতে হবে। এতে অন্য দলের মধ্যে আস্থা আসতে পারে।
হাবিবুর রহমান খান,,
SUE’ JGNTR
You cannot copy content of this page