সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৩ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
নিখোঁজ শিশু’কে উদ্ধার করে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিলেন ভোলা সদর মডেল থানা পুলিশ দৈনিক আমার দেশ’কে ভোলার রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনদের অভিনন্দন সা’দপন্থীদের বাংলাদেশে নিষিদ্ধের দাবিতে ভোলায় বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভা ভোলায় বাবা-ছেলে আগ্নেয়াস্ত্র সহ কোস্টগার্ডের হাতে আটক ভোলায় ইটভাটা মালিক সমিতির ২৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন আজ ১০ই ডিসেম্বর’ ভোলা পাক’হানাদার মুক্ত দিবস আজ ১০ ডিসেম্বর, ভোলা পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত দিবস ভোলায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধের দাবিতে গনঅধিকার পরিষদের মানববন্ধন ও স্মারকলিপি ভোলায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে আগ্নেয়াস্ত্র ও কার্তুজ উদ্ধার ভোলার ভেলুমিয়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র পরিদর্শন করলেন জেলা পুলিশ সুপার

আজ ১০ই ডিসেম্বর’ ভোলা পাক’হানাদার মুক্ত দিবস

  • প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪
  • ১২ বার পঠিত

শাহরিয়ার ঝিলন॥

আজ ১০ই ডিসেম্বর ভোলা পাকহানাদার মুক্ত দিবস। আজকের এই দিনে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ভোলা পাকহানাদার মুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল চাপের ফলে পাকবাহিনী কোনঠাসা হয়ে পড়ে। নিজেদের জীবন বাঁচাতে ১০ ডিসেম্বর পাকহানাদার বাহিনী ভোলা ত্যাগ করে। তাদের চলে যাবার সাথে সাথে ভোলা সম্পূর্ণরুপে পাকহানাদার মুক্ত হয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা আশপাশ থেকে শহরে প্রবেশ করে শহরের ওয়াপদা পাওয়ার হাউজ এবং পরবর্তীতে জেলা সরকারি বালক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। ১৬ ডিসেম্বর সমগ্র বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও ভোলা স্বাধীন হয় ১০ ডিসেম্বর। আজ ভোলা হানাদার মুক্ত দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে জেলা প্রশাসন ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে ব্যাপক কর্মসূচী হাতে নেওয়া হয়েছে।

ভোলার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট :

ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়া বিধৌত বঙ্গপোসাগরের বেলা ভুমিতে জেগে ওঠা প্রায় এক’শ মাইল দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ২৫ মাইল চিহ্নিত এই ভূখন্ডের প্রধান বেশিষ্ট্য হল, যেদিকে দৃষ্টি যায় সবদিকে সমতল ভূমি। ১৮৪৫ সালে ভোলাকে মহকুমা করা হয়। দীর্ঘ ১৪০ বছর পর ১৯৮৪ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী আনুষ্ঠানিকভাবে ভোলাকে জেলায় উন্নিত করা হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্থান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে উর্ধুকে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত হয়। এর প্রতিবাদে ঢাকায় প্রথম ছাত্র, শিক্ষক বুদ্ধিজীবি বাঙ্গালী সমাজ এর প্রতিবাদ করেন, যা পরবতীতে ৫২’র ভাষা আন্দোলনে পরিনত হয়। আর এর প্রভাব পড়তে দেখা গেছে একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলায়, এখানকার তৎকালীর বুদ্ধিজীবি ও সচেতন সমাজ আন্দোলনের ঝান্ডা নিয়ে রাস্তায় বেড়িয়ে আসেন। ভোলায় ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন শাহজাহান। তিনি তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ছাত্র শিক্ষক প্রতিবাদ করে কাশ বর্জন করে আন্দোলনে নামেন। বিশ্লেষকদের ভাষ্য অনুযায়ী ৫২’র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই মুক্তির চেতনার বীজ ভোলায় বপন করা হয়। এর পর ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণ অভ্যুত্থানে সারাদেশের মত ভোলাবাসী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহন করে।

ভোলায় ৭০’র প্রলয়ংকারী বন্যা ও ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ: ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকারী জলোচ্ছ্বাসে ভোলায় কয়েক লাখ লোক মারা যায়। ভেসে যায় মানুষ, গবাদি পশু, ঘর-বাড়ি সহ সবকিছু। অনেকে হারান তাদের প্রিয়জনকে সেই শোক কাটতে না কাটতেই ৭১’র যুদ্ধ শুরু হয়, আর এতেও ভোলার কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়।

ভোলায় পাকবাহিনীর আগমন: ভোলা নদী বেষ্টনী হওয়ায় পাকবাহিনী সহজে এখানে আসতে পারেনি। তাদের বড় একটি দল ২মে ভোলা মহকুমার দায়িত্বভার গ্রহন করে। তারা কয়েকটি ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে যায় এবং একটি দল ভোলার বোরহানউদ্দিন হয়ে লালমোহন গিছে পৌঁছায়। ৯ মে অপরাহ্নে পাকসেনারা আবার ভোলায় ফিরে আসে, এসময় তারা দুইজন নিরীহ হিন্দু বৃদ্ধকে গুলি করে হত্যা করে।

ওয়াপদা রেস্ট হাউজের বধ্যভূমি: ভোলা পৌর এলাকার চরজংলা মৌজায় অবস্থিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রদান কার্যালয় ওয়াপদা কলোনীর পূর্ব পার্শ্বস্থ দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে ভোলার প্রধান ও একমাত্র বধ্যভূমি। ৭১’র যুদ্ধের সময় পাক বাহিনী এখানেই তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। ওয়াপদা রেস্ট হাউজ থাকায় নানাবিধ সুবিদার কারনে পাক বাহিনী রেস্ট হাউজ দখল করে নিরীহ মানুষের উপর তান্ডবলীলা চালায়। ভোলার সবগুলো থানার সাথে যোগাযোগের রাস্তা রেস্ট হাউজ সংলগ্ন হওয়ায় এটিকেই নিরাপদ স্থান মনে করে পাকবাহিনী। তারা এখানে দুটি বাংকার তৈরী করে। ভোলায় অবস্থানরত পাকবাহিনীর প্রধান ছিলেন মেজর জাহান জেব খান। তার নির্দেশে রেস্ট হাউজের দক্ষিন পূর্ব পার্শস্থ দুটি কামরা প্রস্তুত করা হয় নির্যাতনের সেল হিসেবে। এখানে কত মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা কারা হয়েছে তার সঠিক হিসাব দেয়া সম্ভব নয়।

খেয়াঘাটের বধ্যভূমি: পাকবাহিনী ভোলায় আগমনের পর মে থেকে জুনের মধ্যে সর্বত্র তাদের অবাদ বিচরন ঘটে। খেয়া ঘাট শহরের কাছাকাছি হওয়ায় পাকবাহিনী নির্বিচারে শান্তি প্রিয় ভোলাবাসীদের হত্যাকরে লাশ পানিতে ভাসিয়ে দিত। এখানে শুধু লাশই ফেলা হত না একই সাথে কয়েকজনকে ধরে এনে লাইনে দাড় করিয়ে গুলিকরে হত্যাকরত পাকবাহিনী। খেয়াঘাটে নিহত কয়েকজনের নাম পরবর্তীতে জানা যায় এরা হচ্ছে- শহীদ জালাল আহম্মেদ, নাসির আহম্মেদ, আজিজল ব্যাপারী, বাবু বিনোদ বিহারী মজুমদার, সরুপ চৌকিদার, রাধা গোবিন্দ ও উপেন্দ্র দাস।

ভোলার যুদ্ধ: ৭১’র এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে খুব গোপনীয়ভাবে ভোলা শহরের লেকু মিয়ার বাসায় প্রথম মুক্তিযুদ্ধের বৈঠক বসে। এতে উপস্থিত ছিলেন সাবেক এমপি ও প্রতিমন্ত্রী মোশারফ হোসেন শাহজাহান, সামসুদ্দিন আহম্মেদ, মোস্তাফিজুর রহমান মাস্টার, ডাঃ আব্দুর হাই মিয়া সহ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ। তারা একেক জন একেক দায়িত্ব নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদেও ট্রেনিং, অস্ত্র সহ বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। তাদের সুদক্ষ নের্তৃত্বে একটি কমান্ড বাহিনী গঠিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ভোলা মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ভোলা মহকুমায় বেশ কয়েকটি যায়গায় পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মূখ যুদ্ধ সংঘঠিত হয় এর মধ্যে, ওসমানগঞ্জের যুদ্ধ, দেউলার যুদ্ধ, বাংলাবাজার যুদ্ধ, দৌলতখান যুদ্ধ ও ঘুইংগার হাটের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। এসব যুদ্ধে পাকবাহিনীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা সদস্য নিহত হয়।

যাদের হারাল: মোতাহার মাস্টার- এক কিংবদন্তী চেতনার নাম। ভোলায় মুক্তিযুদ্ধে যাদের অবদান স্মরণীয় তাদের অন্যতম মোতাহার মাস্টার। ভোলার লালমোহনে জন্ম মোতাহার মাস্টারের, পিতা মৌলভী মোহাম্মদ সুলতান আহমদ। পেশায় ছিলেন স্কুল শিক্ষক ৭১’র ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার পর তিনি নিজ উদ্যোগে উপজেলার গজারিয়ায় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারীদের স্কুল মাঠে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেন। মুক্তিকামী মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্য অনুপ্রানীত করেন। একটি শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গঠন করে শত্রুর মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। মে মাসে ভোলায় প্রথম পাকবাহিনী প্রবেশ করার সময় গেরিলা কায়দায় তাদের উপর আক্রমণ করেন। তিনি ভোলার বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য সম্মূখ যুদ্ধে অংশ নেন। তার সুদৃঢ় নের্তৃত্বের কারনে পাকবাহিনী কোনঠাসা হয়ে পড়ে এবং ভোলা থেকে পলায়ন করে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানে তিনি অংশ গ্রহন করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে ১৯৭৫ সালের দশ জানুয়ারী গজারিয়া বাজারে এক অনুষ্ঠানে আততায়ীর হাতে নিহত হন মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা এই নায়ক। আজও ভোলার মানুষ মোতাহার মাস্টারকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

দানবীর নলিনী দাস: ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ নলিনী দাস ১লা জানুয়ারী ১৯০১ খ্রিঃ ভোলার উত্তর শাহবাজপুরে জন্ম গ্রহন করেন। ব্রিটিশ সরকারের অন্যায় আর অত্যাচারের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর নলিনী দাস বার বার কারা বরন করেছেন। তবুও ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন থেকে পিছপা হননি। তিনি বেশ কয়েকবার ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। ১৯৩৩ সালে ব্রিটিশ পুলিশের সাথে যুদ্ধে নলিনী দাস পায়ে গুলি লেগে বন্দী হন। দীর্ঘ ১৩বছর বন্দী জীবন কাটিয়ে ভারত বিভক্তির পর দেশে ফিরে আসেন এবং অসহায় মানুষের কল্যানে নিজেকে বিলিয়ে দেন। ১৯৭১ সালের মুক্তযুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশগ্রহন করেন। এবং ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা করেন।

বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল: ছোট বেলা থেকেই ডানপিঠে ছিলেন মোস্তফা কামাল। স্বপ্ন ছিল সৈনিক হবেন, কিন্তু এতে বাঁধসাধেন বাবা। একরোখা আর ডানপিঠে সভাবের মোস্তফা কামাল বাড়ি থেকে পালিয়ে যোগদেন সেনাবাহিনীতে। প্রথমেই তার পোস্টিং হয় কুমিল্লা সেনানিবাসে। ৭১’র মার্চের মাঝামাঝি ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার পর মেজর শাফায়াত জামিল তার গুটিকয়েক বাঙালী সেনা সদস্য নিয়ে পাক অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল খিজির হায়াত খান ও পাকিস্থান সেনাদের নিরস্ত্র করে বন্দী করেন। আর এই মিশনে অংশগ্রহন করেন সিপাহী মোস্তফা কামাল। একে একে শুরু হয় প্রতিরোধ। সিপাহী মোস্তফার সাহস, বুদ্ধি ও কর্মতৎপরতা দেখে মেজর শাফায়াত জামিল তাকে যুদ্ধকালীন সময়ে ল্যান্সনায়েকের দায়িত্ব প্রদান করেন। এতে মোস্তফা কামাল ১০ জন সৈন্যেও সেকশন কমান্ডার হন। ১৬ই এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে চিহ্নিত করার জন্য কুমিল্লা-আখাউড়া রেললাইন ধরে উত্তরদিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী দরুইন এলাকায় পৌঁছে মুক্তিযোদ্ধাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে, এরকম অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপদতা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। সবাই পিছু হটলেও আসেনি মোস্তফা কামাল এলএমজি দিয়ে গুলি চালিয়ে পাকবাহিনীকে তটস্থ করে রাখেন। আর এরই মাঝে বাকী মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে স্থান ত্যাগ করেন। পাকবাহিনী এলাকা ছেড়ে চলে গেলে মোস্তফা কামালকে খুঁজে না পেয়ে পুণরায় দরুইন আসেন মেজর শাফায়াত জামিল ততক্ষনে এলাকাবাসী ট্রেনের কাছে একজনকে পড়ে থাকতে দেখেন। গায়ে গুলি ও বেয়নেটের দাগ মাটিতে পড়ে আছেন মোস্তফা কামাল। তার আত্মত্যাগের কারনে বেঁচে গেলেন বাকী মুক্তিযোদ্ধারা। এলাকাবাসী সেখানেই তাকে সমাহিত করলেন। তার এই মহান ত্যাগ ও বীরত্বের জন্য পেয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠের মর্যাদা। আর ভোলাবাসী পেয়েছেন তাদের বীর ও গর্বের প্রতীক ৭জন বীরশ্রেষ্ঠের একজন মোস্তফা কামাল।

Facebook Comments Box
এ জাতীয় আরও খবর

ফেসবুকে আমরা

You cannot copy content of this page